March 20, 2018
চাকুরীর ইন্টারভিউতে যে সব জিনিস মাথায় রাখা জরুরি! চাকুরীর ইন্টারভিউ টিপসএকজন মোহাম্মদ আশরাফুল এর গল্প
গল্প লিখতে বসেছি আজ। আসলে এটাতো গল্প নয়, এটা হল ক্রিকেট বিশ্বের এক ছোট্ট বোকা সোকা বালকের ক্রিকেট কাহিনী।১৯৮৪ সালের ৭ই জুলাই যে ছেলেটার জন্ম ঢাকায়। ডাক নাম মতিন আর ক্রিকেটীয় নাম অ্যাশ! উইকেটের পিছনে ব্যাট ঘুরিয়ে মারার শট যার নামে ছিল অ্যাশ স্কুপ।
ছোটবেলা থেকে এখন পর্যন্ত আশরাফুলের শটের পাগল আমি। কিভাবে শট খেলতো ভাবি এখনও! সবচেয়ে বড় কথা ওর মত খেলার ধরণ আমাদের বর্তমান জাতিয় দলের কয়েকটা প্লেয়ারেরও নেই। ভাল খেলে অনেকেই, কিন্তু ৩/৪ জনের মাইর ছাড়া আগের মতন তেমন স্বাদ পাইনা আমি।
পেস বলে আগ্রাসী পুল শর্ট |
২০০০ সালের ২২শে নভেম্বর ঢাকা মেট্রোপুলিশ ক্রিকেট টীমের হয়ে নিজের ফার্স্ট ক্লাশ ক্যারিয়ার শুরু করেন এই ছোট্ট কিংবদন্তী মোহাম্মদ আশরাফুল। সেই ম্যাচে উনি ৪১ আর ৬ রান তুলেন নিজের ব্যাট থেকে আর স্লো লেগ স্পিন বল করে মাত্র ৫৯ রান দিয়ে তুলে নেন ৫টি উইকেট। ফার্স্ট ক্লাশ কারিয়ারের ২য় ম্যাচে করেছিলেন নিজের প্রথম সেঞ্চুরি।
বাংলাদেশ জাতীয় টীমের হয়ে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের সূচনা করে ১১ই এপ্রিল ২০০১ তারিখে জিম্বাবুয়ের সাথে খেলে। সেদিন বাংলাদেশ ৩৬ রানে হেরেছিল আর অ্যাশ করেছিলেন ৯ রান তবে সেদিনই নিজের প্রথম ওয়ানডে উইকেট তুলে নেন বিখ্যাত এন্ডি ফ্লাওারকে আউট করে।
ওয়ানডে সূচনার মত এতটা নিষ্প্রভ হয়নি টেস্টের বেলায়। ২০০১ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর শ্রীলঙ্কার সাথে ১১৪ রান করে করে ক্রিকেটের সবচেয়ে কম বয়সি ব্যাটসম্যান হিসেবে সেঞ্চুরি করার এক অনবদ্য রেকর্ড গড়েন আশরাফুল। ১৬ বছর ৬২ দিন বয়সের সেই পিচ্চি আশরাফুল নিজের প্রথম ইনিংসে ২৬ রান করেছিলেন কিন্তু ২য় ইনিংসেই কলম্বোর সেদিনের দর্শক, পিচ এবং স্বয়ং আম্পায়ারকে সাক্ষী রেখে বিশ্বসেরা বোলার মুরালি, ভাসদের পিটিয়ে ১১৪ রান করে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন জীবনের প্রথম টেস্ট ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ এ্যাওয়ার্ড! বোধহয় আজো সেই দিনের কথা মনে রেখেছে মুরালি আর ভাস, যেখানে বড় বড় অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান ওদের বলের সামনে নাস্তানাবুদ সেখানে পিচ্চি ছোকরাটা কি দশাই না করেছিল!
প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি করা আশরাফুল। |
২০০৪ সালে চট্টগ্রামে ভারতের বিপক্ষে টেস্টে কুম্বলে, পাঠানদের বেধড়ক পিটিয়ে অপরাজিত ১৫৮ রান করে বাহবা পেয়েছিলেন ক্রিকেটের মহারথি শচীন টেন্ডুলকারের কাছ থেকে। ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ হয়েছিলেন পাঠানের সাথে যৌথভাবে।
বাহবা দিচ্ছেন শচীন। |
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথমবারের মত শ্রীলঙ্কার সাথে ড্র করার পথে অন্যতম নায়ক ছিলেন এই আশরাফুল! ৮ই মার্চ ২০১৩ সালে ১৯০ রানের অসাধারণ এক ইনিংস উপহার দেন বাংলাদেশের ইতিহাসে আমার দেখা সর্বকালের সেরা মাস্টারক্লাশ ব্যাটসম্যান। সেই ম্যাচে মুশফিকুর ২০০ আর নাসির ১০০ রান করেছিলেন তবে মুল ভিত্তিটা গড়েছিলেন অ্যাশ।
১৫০ রান করার পর অ্যাশকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন মুসফিকুর |
মনে পরে যায় ২০০৫ সালের ১৮ই জুন কার্ডিফের সেই ন্যাটওএস্ট সিরিজের মহাপরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়ার সাথের ওয়ানডে ম্যাচের কথা! ২৫০ রানের টার্গেটকে কি নিষ্ঠুরভাবে একটু একটু করে ভেঙ্গে দিলেন নিজের ১০১ বলে ১০০ রানের এক অবিস্মরণীয় ইনিংস খেলে। রিকি পন্টিং, এন্ড্রু সাইমন্ডস কে এমন বিমর্ষ অবস্থায় সেদিনের আগে কেউ দেখেনি। খোদ অ্যাডাম গিল্ক্রিস্ট তালি দিয়েছিলেন সেই ইনিংস দেখে। অ্যাশের এই সেঞ্চুরিটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে ২য় ওয়ানডে সেঞ্চুরি।
অস্ট্রেলিয়ার সাথে সেঞ্চুরি করার পর উচ্ছ্বাস |
একি টুর্নামেন্টের পরের ম্যাচে ২১ তারিখে আরেক পরাশক্তি ইংল্যান্ডের ৩৯২ রানের পাহাড়সম টার্গেটে তাড়া করতে নেমে ফ্লিন্টফ, হারমিশন কে নাকানিচুবানি দিয়ে মাত্র ২১ বলে ফিফটি করেন। শেষ পর্যন্ত ৫২ বলে ৯৪ রান করে আউট হন তিনি। সেদিনের ধ্বংসজজ্ঞ মনে রাখার মত।
২০০৭ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপে ২য় রাউন্ডে দক্ষিণ আফ্রিকার শক্তিশালি পেস অ্যাটাককে এক হাতে তুলে নিয়ে ৮৭ রানের বিস্ফোরক এক ইনিংস খেলে দলকে জয়ের দ্বারপ্রান্তে এনে দেন অ্যাশ। সেদিন শেষ হাসি আমরাই হেসেছিলাম।
ওয়ানডে আর টেস্টের মত টি টুয়েন্টিতে অ্যাশ বাংলাদেশ কে দেখিয়েছেন কিভাবে দানব গেইলদের বিপক্ষে বাঘের মত জিততে হয়। ১৩ই সেপ্টেম্বর জোহানেসবারগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ১৬৫ রানের টার্গেট কে তুলার মত উড়িয়ে দিয়েছিলেন এই আশরাফুল। ২৭ বলে ৬১ রান করে বাংলাদেশকে ৬ উইকেট এবং ২ ওভার আগেই সহজ জয় উপহার দিয়েছিলেন অ্যাশ। সেদিনের করা ২০ বলে ফিফটি ছিল টি টুয়েন্টিতে তখনকার ফাস্টেস্ট ফিফটি।
আশরাফুলের কিছু অসামান্য রেকর্ড সমুহঃ
১. অনেকেই হয়তো জানেন না যে, টেস্ট ক্রিকেটে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কম সময়ে ফিফটি করেছেন আশরাফুল। মাত্র ২৭ মিনিটে ভারতের বিপক্ষে ২০০৭ সালে মিরপুর স্টেডিয়ামে। সবচেয়ে কম বলের দিক থেকে আছেন শীর্ষ ৩ নাম্বারে ২৬ বল খেলে এই ম্যাচেই। প্রথমে আছেন জ্যাক ক্যালিস ২৪ বলে ফিফটি জিম্বাবুয়ের সাথে।
২. ২০০৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত টি টুয়েন্টিতে দ্রুৎ ফিফটির রেকর্ড ছিল আশরাফুলের।২০ বলে করা ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ২০০৭ বিশ্বকাপে। এখন অবশ্য চলে এসেছেন ৫ নাম্বারে।
৩. ওয়ানডেতেও ফাস্টেস্ট ফিফটির কাতারে আছেন ৫ নাম্বারে। ২১ বলে করা ইংল্যান্ড ম্যাচের জন্য।
৪. সর্বকনিষ্ঠ ক্রিকেটার হিসেবে টেস্টে সেঞ্চুরি করা প্লেয়ার এখনও আশরাফুল। ২০০১ সালে শ্রীলংকার সাথে ১১৪ রান করেন ১৬ বছর ৬২তম দিনে।
সর্বকনিষ্ঠ সেঞ্চুরিয়ানকে মাহেলার অভিনন্দন |
৫. টেস্টে হাবিবুল বাশারের পর বাংলাদেশের ২য় সর্বোচ্চ রান আশরাফুলের।
৬. বাংলাদেশ থেকে টেস্টে সর্বোচ্চ ৬ সেঞ্চুরির মালিক আশরাফুল।
৭. বাংলাদেশের হয়ে টেস্টে সর্বোচ্চ রানের পার্টনারশিপে আছে আশরাফুল আর মুশফিকুর। ২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৫ম উইকেটের জুটিতে তারা করেন ২৬৭ রান।
টেস্টে সর্বোচ্চ রানের পার্টনারশিপে আছেন আশরাফুল আর মুশফিকুর |
৮.ইন্ডিভিজুয়ালি টেস্টে এক ইনিংসে ২য় সর্বোচ্চ রান আশরাফুলের। ১৯০ রান শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে।
খেলা বিশ্লেষণঃ
নিন্দুকেরা বলে আশরাফুলের জন্য বাংলাদেশ যে কয়টা ম্যাচ জিতেছে এর বেশি হেরেছে। আসলে আমরা আশরাফুলের কম রানে কখনই সন্তুষ্ট থাকতে পারি নাই। আশরাফুল মানেই দেখতাম অনেকগুলো সুন্দর চোখ ধাঁধানো শর্ট আর চোখের পলকে বাউন্ডারির বাইরে চলে যাওয়া বল। বল যতই ফাস্ট হোক না কেন, কত সুনিপুণ হাতে ব্যাটটা কে ঘুরিয়ে স্কুপ খেলে চার! ব্যাপারটা হয়েছে আসলে শচীনের মত, যেমন নিন্দুকেরা বলে শচীন যে ম্যাচে সেঞ্চুরি করে সেই ম্যাচ ভারত হারে।
আশরাফুল বেশ বিনয়ি আর বোকা সোঁকা টাইপের ছেলে, এজন্যই বিশাল ধাঁধায় পরে গিয়ে নিজের পুরো ক্যারিয়ার ধ্বংস করেছে নিজ হাতে। ক্রিকেটের ভাষায় যাকে অসচেতন বল্লেও ভুল হবেনা। সে প্রায়ই দায়িত্ব নিয়ে খেলত না, যদিও যখনি সে ব্যাট করতে নামতো তখনি মাথায় বিশাল প্রেশার নিয়েই নামতে হতো।
১১৯ টেস্ট ইনিংসে ২৪ গড়ে মোট রান করেছেন ২৭৩৭। সেঞ্চুরি ৬ টি, হাফ সেঞ্চুরি ৮টি আর ডাক আছে ১৬টি।
১৬৮ ওয়ানডে ইনিংসে ২২.৩৭ গড়ে মোট রান করেছেন ৩৪৬৮। সেঞ্চুরি ৩ টি, হাফ সেঞ্চুরি ২০ টি আর ডাক আছে ১৩টি
বাংলাদেশ আজ অনেক দূর চলে এসেছে ক্রিকেটে, কিন্তু যাদের হাত ধরে এইদিন দেখছে মানতে দ্বিধা নেই যে তাদের মধ্যে একজন হলেন মোহাম্মদ আশরাফুল।
কিছু বিতর্কঃ
২০১৩ সালের বিপিএলের ২য় আসরে এসে শুনা যায় আশরাফুলের ম্যাচ ফিক্সিংএর কথা। ২০০৪ সাল থেকে নাকি সে ম্যাচ ফিক্সিং এর সাথে জড়িত! ১৮ জুন ২০০৫,৯ বছর আগে যেই দিনে মোহাম্মদ আশরাফুলের ঐতিহাসিক ১০০ রানের উপর ভর করে বাংলাদেশ ১ম বারের মত তখনকার সময়ের বিশ্ব ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় পরাশক্তি অস্ট্রেলিয়া কে হারিয়েছিল,এখনও পর্যন্ত যেই স্মৃতীটা প্রতিটা বাঙ্গালীর গর্ব করার একটা কারণ। আর ঠিক ৯ বছর পর সেই একই দিনে আশরাফুলকে ম্যাচ ফিক্সিং এর দায়ে অভিযুক্ত করে তার বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করা হয়। আশরাফুল যদিও নিজেও স্বীকার করেছেন তার এই ভুলের কথা, আর তার শাস্তি হিসেবে পেয়েছেন ৮ বছরের জন্য নিষেধাজ্ঞা আর সাথে ১০ লাখ টাকার জরিমানা।
মিডিয়াকে নিজের ভুলের স্বীকারোক্তি দিচ্ছেন আশরাফুল |
অন্যায়ের শাস্তি হবেই, সে যেই হোক না কেন। অনেকেই যদিও ফিক্সিং এর এই ঘটনাকে ভারতের সাজানো খেলা হিসেবে বলেছিলেন। কিন্তু গুরুত্বর অপরাধ করে আসছিল সে, যেটা হয়তো ক্ষমার অযোগ্য। আর ধরা খাবার পর দোষ স্বীকার করে সবার থেকে ক্ষমাও চেয়েছে সে। সেতো জানতো এভাবে সবার সামনে স্বীকার করার পর জাতির কাছে সে আজীবনের জন্য মীরজাফর ট্যাগ পেয়ে যাবে। শুধু সেই না, তার পুরো বংশধর যারা এখন বর্তমান আর যারা ভবিষ্যতে আসবে তারাও পোহাবে আশরাফুলের অন্যায়ের যন্ত্রণা।
কিন্তু সে কি একাই??? একা একটা মানুষ এভাবে দোষ করতে পারে কি? শুধু মাত্র ওকেই আমরা দোষ দিচ্ছি কারন আমরা তো নরমের জম,তাই না? কেন পারি না ওর সাথে বা ওকে এই দোষের সাথে যারা প্রভাবিত করেছে?
কারণ তারা অনেক ভেতরের মানুষ। আমরা তাদেরকে কখনও হয়তো আবিষ্কারই করতে পারবো না। আর পারলেও শাস্তি দিতে কি পারবে আমাদের আইন/আদালত? এদের মধ্যে কয়েকজনকে ওই ম্যাচগুলোর জন্য বিভিন্নভাবে শাস্তি দেয়া হয়েছে কিন্তু আশরাফুলের শাস্তির তুলনায় সেগুলো একান্তই নগণ্য!
একটাই কথা বলতে চাই আজকের দিনে, শুভ জন্মদিন এ গ্রহের অন্যতম সেরা ক্লাসিক ব্যাটসম্যান এবং বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান লিজেন্ড মোহাম্মদ আশরাফুল। শুভ ৩০ তম জন্মদিন,মোহাম্মদ আশরাফুল।